হাদীস শাস্ত্র এবং ইমাম আবু হানীফা রহঃ

হাদীস শাস্ত্র এবং ইমাম আবু হানীফা রহঃ

হাদীস শাস্ত্র এবং ইমাম আবু হানীফা রহঃ

© আবদুর রহমান মু’আজ

মুহাদ্দিসীন কেরামের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে হাদীসের জন্য সফর করা। এই ধরনের সফরকে বলা হয় ‘ الرحلة في طلب العلم ‘ বা শিক্ষা সফর।

রাসূল সঃ বলেছেন-

” যে ব্যক্তি ইলম তালাশ করার জন্য কোন পথে চলে, আল্লাহ তায়ালা এই উসিলায় তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। [১]

ইমামে আযম আবু হানীফা রহঃ হাদীসের একজন সার্থক ছাত্র হিসেবে এই সফরের হক আদায় করেছেন।

ইমাম যাহাবী রহঃ (মৃত্য ৭৪৮ হিজরী) বলেন-

الإمام، فقيه الملة، عالم العراق، أبو حنيفة.. وعني بطلب الآثار، وارتحل في ذلك

” ফকিহুল মিল্লাত, ইরাকের আলিম ইমাম আবু হানীফা হাদীস অন্বেষণে মনোনিবেশ করেছেন এবং হাদীসের জন্য সফর করেছেন। ” [২]

ইমাম যাহাবী বলেন –

” কূফাবাসীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ হচ্ছেন আলী ও ইবনে মাসউদ রাঃ, তাঁদের শাগরেদগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ হচ্ছেন আলকামাহ রহঃ, তাঁর শাগরেদগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ হচ্ছেন ইবরাহীম আননাখায়ী রহঃ, ইবরাহীমের শাগরেদগনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ হচ্ছেন হাম্মাদ রহঃ, হাম্মাদের শাগরেদগনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ হচ্ছেন আবু হানীফা রহঃ, তাঁর শাগরেদগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ হচ্ছেন আবু ইউসুফ রহঃ। আবু ইউসুফ রহঃ – এর শাগরেদগণ দিগদিগন্তে ছড়িয়ে পড়েছেন, যাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ফকীহ হচ্ছেন মুহাম্মদ ইবনুল হাসান রহঃ, আর মুহাম্মদ রহঃ এর শাগরেদগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ফকীহ হচ্ছেন আবু আব্দুল্লাহ আশশাফেয়ী রহিমাহুল্লাহ তা’য়ালা। ” [৩]

উপরের বক্তব্যে ইমাম যাহাবী রহঃ ইলম ও ফিকহের একটি সূত্র বা স্বর্নসিঁড়ি উল্লেখ করেছেন। যার এক মাথায় রয়েছেন হযরত আলী ও ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা, আর শেষপ্রান্তে রয়েছেন ইমাম শাফেয়ী রহঃ। এর মাঝখানে রয়েছেন প্রত্যেক যুগের ইলমী ময়দানের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগণ। যাঁদের মধ্যে ইমামে আযম আবু হানীফা রহঃ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

সদরুল আইম্মা মুয়াফফাক ইবনে আহমাদ আলমাক্কী রহঃ ইমামুল আইম্মা বাকর ইবনে মুহাম্মদ যিরানজারী(মৃত্যু ৫১২ হিঃ) এর সূত্রে লিখেছেন-

انتخاب أبو حنيفة رحم الله كتاب الاثار من اربعين الف حديث

অর্থাৎ : চল্লিশ হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে তিনি (ইমাম আবু হানীফা) কিতাবুল আছার সংকলন করেছেন।

ইমামে আযম আবু হানীফা রহঃ বলেছেন-

عندي صناديق الحديث ما اخرجت منها الا اليسير الذي ينتفع به

অর্থ: আমার কাছে সিন্দুকে সিন্দুকে হাদীস রয়েছে। মানুষের উপকারে লাগবে এমন সামান্যই আমি বের করেছি।

হাফিজ আবু নুয়াইম ইস্পাহানী রহঃ মুসনাদে আবু হানীফায় সনদসহ উল্লেখ করেছেন-

ইয়াহইয়া ইবনে নাসার বলেন- আমি একবার কিতাববোঝাই একটি ঘরে আবু হানীফার সঙ্গে দেখা করলাম। বললাম- এগুলো কী?
বললেন- এসবই হাদীসের পান্ডুলিপি। আমি এ থেকে মানুষের উপকারে আসে এমন সামান্য পরিমাণ বর্ণনা করেছি। [৪]

বিভিন্ন বিষয়ে সুবিন্যস্তরূপে সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ হাদীস সংকলন এই কিতাবুল আছার। এর আগে মুহাদ্দিসগণ হয়তো অবিন্যস্তরূপে উস্তাজের শিরোনামে সংকলন তৈরি করেছেন কিংবা বিশেষ কোন একটি বিষয়ে। একই মলাটে বহুবিষয়ে বিষয়বিন্যাসে সংকলনের ধারা সর্বপ্রথম প্রবর্তন করেন ইমাম আবু হানীফা রহঃ।

ইমাম বুখারী ও ইমাম আবু দাউদের উস্তাজ হাফিজুল হাদীস আলী ইবনুল জা’দ রহঃ থেকে হাফিজ আবু মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ হারেসী বর্নণা করেন-

قال القاسم بن عباد في حديثيه قال على بن الجعد، أبو حنيفة إذا جاء بالحديث جاء به مثل الدر

অর্থ: ইমাম আবু হানীফা রহঃ যখন হাদীস বর্নণা করেন তখন তা মনি-মুক্তার ন্যায় স্বচ্ছ হয়। ( অর্থাৎ মনে হয় যেন মুক্তা ঝরে পড়ছে)
[৫]

ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন এমন এক ব্যক্তি যাকে নিয়ে ইমাম আহম্মদ বিন হাম্বল রহঃ বলতেন , ” যে হাদীস ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীনের জানা নেই, তা হাদীসই নয় “।

সেই ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন থেকে অবিচ্ছিন্ন সূত্রে হাফিজ খতীব আল বাগদাদী তাঁর তারীখে বাগদাদে বর্নণা করেন-

كان أبو حنيفة ثقة لا يحدث بالحديث الا ما يحفظ ولا يحدث بما لا يحفظ

অর্থঃ ” ইমাম আবু হানীফা রহঃ সিকাহ তথা নির্ভরযোগ্য। তিনি কেবল ঐ সকল হাদীসই বর্নণা করেন যেসব হাদীস তাঁর স্মৃতিপটে পূর্নরূপে সংরক্ষিত ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা। যে হাদীস তাঁর মুখস্থ নেই তা তিনি বর্নণা করেন না। ” [৬]

আমীরুল মুমিন ফিল হাদীস ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহঃ ; যাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও সুউচ্চ মর্যাদা আহলে ইলমদের নিকট সর্বস্বীকৃত। যিনি ইমামে আযম আবু হানীফার একনিষ্ঠ ছাত্র। তিনি ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর শানে স্বরচিত কবিতায় বলেন-

روى اثاره فأجاب فيها •• كطيران الصقور من المنيفة

অর্থ: তিনি আছার (হাদীস) বর্নণায় এমন উচ্চশিখরে পৌঁছেছেন, যেমন শিকারী পাখি অনেক উঁচুতে বিচরণ করে ও উড়ে বেড়ায়।

ولم يك بالعراق له نظير •• ولا بالمشرقين ولا بكوفة

সুতরাং, না ইরাকে তাঁর দৃষ্টিপাত ছিল, না প্রাচ্যে কিংবা পাশ্চাত্যে আর না কুফাতে। [৭]

আমীরুল মুমিন ফিল হাদীস আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রহঃ বলেন-

আমি হাসান ইবনে উমারাকে দেখেছি ইমাম আবু হানীফার উটের রশি ধরে হাঁটছেন আর বলছেন- ” আল্লাহর কসম! ফিকহে আপনার চাইতে প্রাঞ্জল গভীর স্থির ও প্রতুৎপন্নমতি আর কাউকে আমরা পাইনি। আপনি আপনার কালের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সেরা বাগ্মী। মানুষ হিংসার কারণেই আপনার সমালোচনা করে” [৮]

আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহঃ যাকে ছাড়া সহীহ বুখারী সহীহ মুসলিম পূর্নতা পেতো না।

তিনি ইমামে আযম আবু হানীফা রহঃ নিয়ে অন্যত্র বলেন –

” আমরা যখন ইমাম আবু হানীফার সামনে বসতাম তখন মনে হতো বাজপাখির সামনে বসা ক্ষুদ্র পাখি।”

তিনি আরো বলেন –

لو لا أن الله أغاثني بأبي حنيفة و سفيان كنت كسائر الناس

অর্থাৎঃ আল্লাহ তায়ালা যদি আমাকে আবু হানীফা এবং সুফিয়ান সাওরী দ্বারা সাহায্য না করতেন তাহলে আমি আর দশজনের মতোই হতাম। [৯]

হাদীস শাস্ত্রের বিখ্যাত ইমাম আওযাই রহঃ। ইমাম যাহাবী যাকে শাইখুল ইসলাম ও হাফিজ উপাধিতে ভূষিত করেন।

ইমাম আবু হানীফার ছাত্র এবং আমীরুল মুমিন ফিল হাদীস আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহঃ বলেন-

” আমি আওযাইর সঙ্গে দেখে করতে সিরিয়া গেলাম। তার সাথে সাক্ষাৎ হলো বৈরুতে। আমাকে দেখা মাত্রই বললেন-

এই খুরাসানী! বলোতো, কুফায় আবির্ভূত এই বিদায়াতি লোকটি কে- যাকে আবু হানীফা বলা হয়?!

আমি তাকে কোন উত্তর না দিয়ে ঘরে ফিরে এলাম।এসে হযরত আবু হানীফার গ্রন্থাবলী পড়তে শুরু করলাম। ভালো দেখে কিছু মাসয়ালা চয়ন করতে লাগলাম।তিনদিন কেটে গেলো এভাবে। তৃতীয় দিন গেলাম আওযাইর কাছে- মসজিদে। তিনি মহল্লার মসজিদের মুয়াজ্জিন এবং ইমাম।

আমার হাতে সংকলিত গ্রন্থ। দেখেই বললেন-

এটা কি বই? আমি তার হাতে তুলে দিলাম। একটি মাসয়ালায় চোখ ফেললেন। আমি তাতে লিখে রেখেছি- নুমান বলেছেন…. আযানের পর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গ্রন্থের শুরুর অংশটা পড়ে ফেললেন।তারপর গ্রন্থটি আস্তিনে রেখে ইকামত দিলেন। নামায পড়ালেন।নামায শেষে বইটি বের করে পড়ে শেষ করলেন।শেষ করার পর আমাকে বললেন –

খুরাসানী! এই নোমান ইবনে সাবিত লোকটা কে?

বললাম- একজন শায়খ, ইরাকে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে।বললেন – এতো এক মহান শায়খ! যাও! তার কাছে গিয়ে আরো কিছু শিখো! আমি বললাম-

هذا أبو حنيفة الذي نهيت عنه

অর্থাৎ – ইনিই আবু হানীফা- যার সান্নিধ্যে যেতে আপনি বারণ করেন। “

আরেকটি বর্নণায় আছে- আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রহঃ বলেছেন-

তারপর আওযাইর সঙ্গে দেখা হয় মক্কা মুকাররমায়।দেখি আওযাই সেই মাসাইয়িলগুলো নিয়ে আবু হানীফার সঙ্গে কথা বলছেন।আর আমি যা লিখেছিলাম হযরত ইমাম তা আরও বিশদভাবে তুলে ধরছিলেন। তাদের বৈঠক ভাঙ্গার পর আমি আওযাইকে বললাম –

আবু হানীফাকে কেমন দেখলেন? বললেন-

غبطت الرجل بكثرة علمه ووفور عقله،واستغفر الله تعالى،لقد كنت في غلط ظاهر، الزم الرجل، فإنه بخلاف ما بلغني عنه

অর্থাৎ -তাঁর বিপুল জ্ঞান আর বিস্তীর্ণ বুদ্বিমত্তায় ঈর্ষান্বিত হয়েছি। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন।আমি খোলামেলা ভুলের মধ্যে ছিলাম। তুমি তাঁর সঙ্গ ছেড়না। তাঁর সম্পর্কে আমরা যা জেনেছি বাস্তবে তিনি তার বিপরীত। [১০]

ইমামে আযম রহঃ জ্ঞানের অথৈ সাগর। এই সাগরের তীরে এসে উম্মাহর দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি ভাগ্যবান কাফেলা শীতল করেছে প্রাণ, আঁজলা ভরে নিয়েছে পথের পাথেয়। আবু হানীফার মশাল হাতে নির্বিঘ্নে চলেছে পথ। এই পথ সোজা মিশেছে পবিত্র মক্কায় এবং প্রাণের মদিনায়। আর প্রাণ-শীতলকরা এই দীর্ঘ কাফেলা দেখে হিংসায় পুড়েছে কেউ কেউ।

হিংসুকেরা জ্বলে পুড়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহ পাকের নিকট ইমামে আযম আবু হানীফার মর্যাদা ততই বাড়তেই থাকবে ইন শা আল্লাহ।

মুহাদ্দিস ইবনে দাউদ আল খুরায়বী রহঃ যথার্থই বলেছেন-

الناس في ابي حنيفة حاسد و جاهل

অর্থ: মানুষ আবু হানীফা সম্পর্কে হয় মূর্খতার স্বীকার অথবা হিংসার। [১১]

একমাত্র ইমাম যিনি সাহাবীদের সুহবাত (সান্নিধ্য) পেয়েছেন, যিনি আল্লাহর রাসূলের সময়ের সবচেয়ে নিকটবর্তী ইমাম, যার নাম নেয়ার আগে ইমাম যাহাবী ” আল ইমাম, ‘ ফকিহুল মিল্লাত ,আ’লিমুল ইরাক ‘ বলে সম্বোধন করেন, তাঁর ব্যাপারে যখন কেউ শোনায় তিনি হাদীস কম জানতেন, হাদীসে যয়িফ(দূর্বল) ছিলেন, লজ্জায় এই মুখ কোথায় লুকাই?

[১] – মুসলিম
[২]-সিয়ারু আলামিন নুবালা- ৬/৩৯০-৩৯২
[৩]-সিয়ারু আ’লামিন নুবালা -৫/২৩৬ বরাতে, মাকানাতুল ইমাম, পৃষ্ঠা ৩৭
[৪]-মাকালাতে হাবীব- ৩;১২৩-১২৪
[৫]-মুহাদ্দিস খুওয়ারযামী, জামিয়ু মাসানীদিল ইমামিল আ’যম ২/৩০৮ দায়েরাতুল মায়ারিফ ১৩৩৩ হিজরী ,
[৬]-তারীখে বাগদাদ ১৩/ পৃ ৪১৯ দারুল ফিকর
[৭]-মুহাদ্দিস খুওয়ারযামী, জামিয়ু মাসানীদিল ইমামিল আ’যম ২/৩০৮ দায়েরাতুল মায়ারিফ ১৩৩৩ হিজরী
[৮]-ইমাম যাহাবী,মানাকিব,৪১ পৃষ্ঠা
[৯]-আসারুল হাদীস ২ঃ২৯৬; মাকানাতুল ইমাম আবু হানীফা ফিল হাদীস,নুমানী-৯৪ পৃষ্ঠা
[১০]-শাইখ আওয়ামা, আসারুল হাদীসিশ শরীফঃ ১২৪-১২৫ পৃষ্ঠা
[১১]- নুমানী, মাকানাতু আবী হানীফা-১২৭ পৃষ্ঠা

Leave a Reply